,

নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন লিবিয়া থেকে পালিয়ে আসা মামুনুর

সময় ডেস্ক : নিজের ভাগ্য ও পরিবারের দিন বদলের জন্য দালালদের মাধ্যমে লিবিয়া গিয়েছিলেন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার ইকড়ছই গ্রামের বাসিন্দা মতিউর রহমানের ছেলে মামুনুর রহমান। গন্তব্য ছিল ইতালি। কিন্তু লিবিয়ায় দালাল চক্রের জালে ফেঁসে ৪৫ লাখ টাকা খুইয়ে ২২ মাস বন্দিজীবন কাটিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় দেশে ফিরতে হয়েছে তাকে। নির্যাতন ও প্রতারণার শিকার মামুনুর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) জগন্নাথপুর থানায় ১৪ জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জগন্নাথপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বিষয়টির তদন্ত করে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে মামুনুর রহমান বলেন, “২০২১ সালের এপ্রিলে জগন্নাথপুর উপজেলার আলাগদি গ্রামের মানব পাচারকারী মুজিবুর রহমানের প্ররোচনায় সাড়ে আট লাখ টাকার চুক্তিতে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে লিবিয়াতে পৌঁছান। লিবিয়ায় পৌঁছে দালালকে আরও চার লাখ টাকা দেন। সেখানে দুই মাস পার হলে জাহেদ নামের এক দালালের ক্যাম্পে পাঠানো হয় তাঁকে। কিছুদিন পরে আমিনুল ও রাজ্জাক দালালের আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ রকম কয়েকটি ক্যাম্পে তাঁকে রাখা হয়। এসব ক্যাম্পে জিম্মি করে গেমের (নৌকায় করে সাগর পাড়ি দেওয়ার প্রক্রিয়া) কথা বলে মুজিবুর আরও ছয় লাখ টাকা নেন। পাঁচ মাস পর এক রাতে গেমের কথা বলে নৌকায় তোলা হয়। কিছুক্ষণ সাগরে ঘোরাঘুরির পর তুলে দেওয়া হয় লিবিয়ার পুলিশের হাতে। পুলিশ নিয়ে গিয়ে ছোট একটি ঘরে বন্দী করে রাখে। সেই ঘরে আমরা ২০০ জন বন্দী ছিলাম। ওই ঘরের সঙ্গে থাকা শৌচাগারের পয়োনিষ্কাশনের ময়লা-আবর্জনার পানি ঘরে হাঁটুসমান জমে ছিল। দুর্গন্ধে শ্বাস-নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মরতে মরতে কোনো রকমে বেঁচে যাই। এক দিন এক রাত থাকার পর বাড়িতে যোগাযোগ করে কদ্দুস নামের আরেক দালালের মাধ্যমে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে সেখান থেকে মুক্ত হই।”
লিখিত অভিযোগে মামুনুর বলেন, “পুলিশের বন্দিখানা থেকে বের হওয়ার পর আবার ইতালি পাঠানোর কথা বলে জগন্নাথপুরের বালিকান্দি গ্রামের দালাল রাসেল ৯ লাখ টাকা নিয়ে এনাম দালালের মাধ্যমে লিবিয়ার মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেন। চক্রটি একটি কক্ষে ১২০ জনকে রাখে। সেখানে টাকার জন্য রশি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে লোহার পাইপ দিয়ে মারধর করতে থাকে আমাকে। মারধরের অডিও এবং ভিডিও মোবাইলের মাধ্যমে বাড়িতে পাঠায়। বাড়িতে আমার ছোট ভাইকে ফোন দিয়ে ১১ লাখ টাকা দাবি করে। দাবি করা টাকা না দিলে আমাকে হত্যা করা হবে বলে জানায়। আমাকে বাঁচাতে জায়গা জমি বিক্রি ও ধারদেনা করে ১১ লাখ টাকা দেওয়া হয়। সেখানে ৭ মাস থাকার পর আরেক মাফিয়ার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ওই খানে তিন মাস আটকে রাখা হয়। চক্রটিকে ৩ লাখ টাকা দিয়েও ছাড়া পাইনি। একদিন গেমের কথা বলে বন্দীদের একটি মাইক্রোবাসে ওঠানো হচ্ছিল। আমাকেও নেওয়া হবে। আমাদের যে ভবনে আটকে রাখা হয়েছিল, হঠাৎ দেখলাম, ভবনের ছাদে লোকজন কেউ নেই। এই সুযোগে আমরা তিনজন ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচের একটি বাগানে পড়ে দৌড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকি। অনাহারে সারা রাত জঙ্গলে থাকার পর ভোরে একটি মসজিদে আশ্রয় নিই। পরে মসজিদের ইমামের সহযোগিতায় দেশে ফিরেছি। শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে এখন চিকিৎসা নিচ্ছি।”
মামুনুর রহমানের ছোট ভাই হিমেল বলেন, ‘ইতালি না পাঠিয়ে একাধিক বার মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় আমার ভাইকে। তাঁকে বাঁচাতে ৪৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় মানব পাচারকারী চক্র। ধারকর্জ আর বাড়ি বিক্রি রেখে এসব টাকা জোগাড় করতে হয়েছে। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’


     এই বিভাগের আরো খবর